এক সময় পূজ্য বনভন্তে নিজ আবাসিক ভবনে ভিক্ষুসঙ্ঘকে ধর্ম দেশনা প্রদান কালে বলেন- চাকমা কথায়, “মিলে লৈ থেলে, মিলে ললে নির্বাণ যেই ন পারিবা। হদ্ হদ্ কাম্ গরিলে নির্বাণ যেই ন পারিবা। নির্বাণ যেইয়ে মান্চে যে হোন্ মিলে লৈ পাত্তা নয়, যে হোন মিলে লৈ থে’ পাত্তা নয়। হ্া কোন কাম্ নেই গরি থা’ পরিবো”। অর্থাৎ নির্বাণ যেতে হলে তোমাদেরকে স্ত্রী লোকের সাথে কামভোগের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হবে। বিবিধ কর্ম হতে নিজকে মুক্ত রাখতে হবে। স্ত্রী লোকের সহিত কামভোগ করলে এবং বিবিধ কর্মে নিযোজিত থাকলে নির্বাণ লাভ করা যায় না। নির্বাণ লাভ করতে হলে স্ত্রীলোকের সহিত কামভোগ করার ইচ্ছা এবং বিবিধ কর্মে নিয়োজিত থাকার বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ চিত্তকে পরীক্ষা করে দেখ, কাম থেকে মুক্ত হতে পেরেছে নাকি, পারনি? যদি ধরা পরে যে, এখনো পরিপূর্ণ মুক্ত হতে পারনি, তাহলে জানবে চিত্তটি দুঃখের মধ্যে রয়েছে। সেই রকম দুঃখগ্রস্ত মলিন চিত্তকে নির্বাণের রঙে রাঙানো সম্ভব নয়। আবার চিত্তকে বিবিধ সংস্কার (কাজ হতে) থেকে মুক্ত থাকতে হবে। চিত্ত বিবিধ সংস্কারে আবদ্ধ থাকলেও দুঃখ পায়, নির্বাণ যেতে পারে না। মনে রাখতে হবে যে, চিত্তের মধ্যে কামভোগের ইচ্ছা এবং বিবিধ সংস্কার থাকলে নির্বাণ যেতে পারে না। নির্বাণ যেতে হলে চিত্ত হতে কামভোগের ইচ্ছা আর বিবিধ সংস্কার (কাজ করার চেতনা) পরিত্যাগ করতে হবে। পূজ্য বনভন্তে ভিক্ষুসঙ্ঘকে প্রশ্ন করেন- নির্বাণ যেতে হলে কি পরিত্যাগ করতে হবে? ভিক্ষুসঙ্ঘ একবাক্যে বলে উঠলেন, কামভোগের ইচ্ছা আর বিবিধ কাজ করার চেতনা পরিত্যাগ করতে হবে। হ্যাঁ, নির্বাণ লাভেচ্ছুকগণকে কামভোগ এবং বিবিধ কর্ম হতে মুক্ত থাকতে হবে। কারন কামভোগ দুঃখ, বিবিধ কর্ম সম্পাদন দুুঃখ। কামভোগ মুক্ত নয় (অর্থাৎ কামভোগের দ্বারা দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না), বিবিধ কর্ম সম্পাদন মুক্ত নয়। অন্যদিকে কামভোগ বা কামভোগের ইচ্ছা না থাকলে সুখ, বিবিধ কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা না থাকলে সুখ। কামভোগের ইচ্ছা না থাকলে মুক্ত, বিবিধ কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা না থাকলে মুক্ত। তোমরা আমার সাথে বলো “আমরা কামভোগ করার ইচ্ছা পোষণ করব না, বিবিধ কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা করব না। কামভোগ মুক্ত ও বিবিধ কর্ম মুক্ত চিত্তে অবস্থান করব।” তোমাদের চিত্তে কামভোগের ইচ্ছা নেই, বিবিধ কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা নেই-এটাই নির্বাণ সুখ লাভের অবস্থা।
তোমরা রমণীর প্রতি সুখ দৃষ্টিতে তাকাবে না। তাদেরকে বিয়ে করার এবং স্বামী-স্ত্রী হয়ে সংসার করার চিত্ত উৎপন্ন করবে না। তাহলে ধ্যান অনুশীলন করতে সক্ষম হবে; আর জ্ঞান উদয় হবে। সেই ধ্যানানুশীলন ও জ্ঞানের মাধ্যমে নির্বাণ সুখ উপলব্ধি হবে। তাই তোমাদের আসল কর্তব্য হল, ধ্যানানুশীলন ও জ্ঞান উদয় করা। তোমরা সর্বদা মনে মনে ধ্যান অনুশীলন ও জ্ঞান উদয় করবে। মনে রাখবে, ধ্যান অনুশীলন ও জ্ঞান উদয়ই সুখ। কিভাবে ধ্যান অনুশীলন করবে? লোভ চিত্তে কোন রমণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করবে না। চিত্তের মধ্যে বিয়ে করার বা সংসারী হয়ে যাওয়ার কোন চিন্তা, কল্পনা, পরিকল্পনার স্থান দিবে না। এসব অকুশল চেতনা চিত্তে স্থান না দিলে ধ্যান অনুশীলন করা যায় বা ধ্যান সুখ লাভ হয়। সর্বদা মনে মনে জ্ঞানের সহিত অবস্থান করলে নির্বাণ সুখ হয়। তোমরা সর্বদা মনে মনে ধ্যান অনুশীলন করবে, জ্ঞান উদয় করবে, তবেই তোমাদের সুখ লাভ হবে। অন্যদিকে তোমাদের চিত্তে যদি অজ্ঞান উদয় হয় তাহলে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যাবে। তখন আর দুঃখের সীমা থাকবে না। ধ্যান ও জ্ঞানবিহীন প্রব্রজ্যা জীবন অতীব দুঃখের হয়ে থাকে। আমি বহু ভিক্ষুকে বলতে শুনেছি “ভিক্ষু জীবন অতীব কষ্টকর।” পূজ্য বনভন্তে জনৈক ভিক্ষুর নাম উল্লে¬খ করে বলেন সে আমাকে বলেছিল- ‘কষ্ট পাচ্ছি।’ তারা কেন কষ্ট পাচ্ছে জান? তাদের ধ্যান নেই, জ্ঞান নেই বলে। মনে রাখবে যার ধ্যান নেই, জ্ঞান নেই সে দুঃখ পাবেই। প্রব্রজ্যা হওত শুধুমাত্র চীবর পরিধান, মস্তক মু-ন করলে সুখ লাভ হয় না। প্রব্রজিতদেরকে ধ্যান ও জ্ঞান লাভে লাভী হতে হবে। ধ্যানী ও জ্ঞানী হতে পারলে তবেই সুখ লাভ হয়-অন্যথায় নয়। আমার সাথে বলো “যেই ভিক্ষুর ধ্যান নেই জ্ঞান নেই, সে ভিক্ষু দুঃখ পাবে।” বর্তমান ভিক্ষুদের নিকট ধ্যান নেই, জ্ঞান নেই বলে তারা দুঃখ পাচ্ছে। কিভাবে ধ্যান সুখ লাভ হয় জান? রমণীদের প্রতি অনুরাগবশতঃ সুন্দর, শুচি, সুখ বলে চেয়ে না থাকলে এবং বিয়ে করার চিত্ত না করলে। অর্থাৎ অমুক রমনীটি দেখতে সুন্দরী, সুশ্রী, ভালো; তাকে বিয়ে করলে আমার সুখ লাভ হবে এরূপ মনে করতঃ বিয়ে করার চিত্ত উৎপন্ন করলে এবং সেই চিত্তে অবস্থান করলে ধ্যান সুখ লাভ হয় না। অধিকন্তু সেইরূপ চিত্ত উৎপন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায়। নির্বাণ সুখ লাভ করতে হলে মনে মনে জ্ঞান উদয় করতে হবে বা জ্ঞানের সহিত অবস্থান করতে হবে। মনে মনে অজ্ঞান উদয় হলে নির্বাণ সুখ লাভ হয় না। মনে মনে অজ্ঞান উদয় হলে পাপ চেতনার জন্ম হয়। সেই পাপ চেতনার দ্বারা মনের মধ্যে অশান্তি বা দুঃখভাব বিরাজ করে। কাজেই সেরূপ দুঃখপূর্ণ চিত্তে কি নির্বাণ সুখের প্রত্যাশা করা যায়? যায় না।
পূজ্য বনভন্তে আরো বলেন- তোমরা যতো রমনীদিগকে লোভ চিত্তে না তাকাবে, তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় না করবে, ততোই তোমাদের সুখ লাভ হবে, নির্বাণ লাভের পথ সুগম হবে। অন্যদিকে তোমরা যতোই মনে মনে রমনীদিগকে লোভ চিত্তে দর্শন করবে, তাদেরকে বিয়ে করতঃ সংসারী সুখ ভোগ করার চিত্তের সহিত অবস্থান করবে ততোই তোমাদেরকে দুঃখ পেতে হবে। আর তখন কিছুতেই নির্বাণ লাভ করা হবে না। মনে রাখবে, রমনীদের প্রতি লোভ চিত্তে না তাকালে এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় না করলে প্রব্রজিত জীবন সুখের হয়। আর রমনীদের প্রতি লোভ চিত্তে তাকালে এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় করলে প্রব্রজিত জীবন অতিশয় দুঃখপূর্ণ হয়। বনভন্তে ভিক্ষুসঙ্ঘকে প্রশ্ন করেন, তোমরা নির্বাণ লাভ করতে চাও কি? হ্যাঁ ভন্তে। তাহালে কোন রমনীর প্রতি লোভ চিত্তে তাকাবে না, কোন রমনীকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না বা তারা কিভাবে কামসুখ ভোগ করে সে নিয়ে কোন চিন্তা মনে স্থান দেবে না। যদি রমনীর প্রতি লোভ চিত্তে তাকানো বন্ধ করতে না পার, বিয়ে করার চিত্ত পরিত্যাগ করতে না পার, তাহলে নির্বাণ লাভ করতে চাইলেও শত ইচ্ছা থাকলে নির্বাণ লাভ হবে না। বরং কষ্টের সহিত প্রব্রজিত জীবন অতিবাহিত করতে হবে; এবং পূণ্যময় জীবনে অপূণ্য বা পাপ অর্জিত হবে। কাজেই তোমরা সবাই সাবধান হয়ে যাও। কোন রমনীর প্রতি লোভ চিত্তে চেয়ে থাকবে না, কোন রমনীকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি, এখন তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন কর। কিভাবে তোমাদের নির্বাণ লাভ হবে, আর কোন পথে চালিত হলে নির্বাণ পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে-সবই বলে দিচ্ছি। এখন সত্যই যদি ইচ্ছুক হও, তাহলে তোমরা নির্বাণ সুখ লাভের পথে অগ্রসর হও। আমি বলে দেয়ার পরও তোমরা যদি তা পালন না কর তাহলে আমার কিছু করার থাকবে না। তদুপরি তোমাদের মনে আশ্রিত কোন রমনীর প্রতি চেয়ে থাকার অনুরাগ এবং বিয়ে করার চিত্তকে তো আমি পরিত্যাগ করায়ে দিতে পারবো না। কারন নিজের চিত্ত নিজকে পরিশুদ্ধ রাখতে হয়, একজনের চিত্ত অন্য জনের পক্ষে পরিশুদ্ধ করে দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমি যতোই বলি না কেন যে, তোমরা রমনীর প্রতি লোভ চিত্তে তাকাবে না এবং তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না, আর তোমরা যদি তা পালন না করে রমনীদের প্রতি লোভ চিত্তে তাকিয়ে থাক ও বিয়ে করার চিত্ত উদয় কর তাহলে তোমাদের নির্বাণ লাভ করা সম্ভব হবে কি? কিছুতেই হবে না। সুতরাং নির্বাণ যেতে পারা না পারাটা তোমাদের চিত্তের উপরই নির্ভর করতেছে। তোমরা নিজেরাই নিজের চিত্তকে পরীক্ষা করে দেখ। কিভাবে করবে? আমার সাথে সাথে বলো “আমাদের মনের মধ্যে রমনীদের প্রতি অনুরাগ আছে কি নেই, এবং তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় হয় কি, হয় না? এভাবেই পরীক্ষা করব”। সে পরীক্ষা করার পর যদি জান যে, তোমাদের মনের মধ্যে রমনীদের প্রতি অনুরাগ নেই এবং তাদেরকে বিয়ে করার চিত্তও উদয় হয় না, তাহলে জানবে তোমাদের পক্ষে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। আর যদি পরীক্ষা করার পর জান যে, তোমাদের মনের মধ্যে রমণীদের প্রতি অনুরাগ আছে এবং রমনী বিয়ে করার চিত্ত উদয় হয় তাহলে জানবে তোমাদের পক্ষে নির্বাণ লাভ করা এখনো সম্ভব নয়। তজ্জন্য আবারো বলছি তোমরা কোন রমনীকে লোভ চিত্তে তাকাবে না, কোন রমনীকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না। লোভ চিত্তে রমনীদের প্রতি না তাকালে সুখ আর তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় না করলে পুণ্য। অন্যদিকে রমনীদেরকে লোভ চিত্তে তাকালে দুঃখ আর বিয়ে করার চিত্ত উদয় করলে পাপ হয়। তোমাদের মনে হয়ত এরূপ প্রশ্ন জাগতে পারে, ভগবান বুদ্ধ কেন আমাদেরকে রমনীদের দিকে লোভ চিত্তে তাকাতে এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় করতে বারণ করেছেন? মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন জাগতে পারে নয় কি? তার উত্তরে আমি বলে দিচ্ছি, তোমরা রমনীদের দিকে লোভ চিত্তে তাকালে দুঃখ পাবে এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় করলে পাপ হবেই বলে ভগবান বুদ্ধ তোমাদেরকে সেগুলো করতে বারন করেছেন। এবার বুঝতে পেরেছ কি? হ্যাঁ ভন্তে। তাহলে আমার সাথে সাথে বলো “রমনীদের দিকে লোভ চিত্তে তাকালে দুঃখ এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় করলে পাপ হয়। আর লোভ চিত্তে না তাকালে সুখ এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় না করলে পুণ্য হয়। তাই আমরা রমনীদের প্রতি লোভ চিত্তে তাকাবো না, বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবো না”। এবার বনভন্তে ভিক্ষুসঙ্ঘকে প্রশ্ন করে বলেন- তোমরা রমনীদের দিকে তাকাবে কি? না ভন্তে। তাদেরকে বিয়ে করবার চিত্ত করবে কি? না ভন্তে। তাহলে তোমরা নির্বাণ যেতে পারবে। কিন্তু এসবের উল্টোপাল্টা করলে নির্বাণ যেতে পারবে না। ভন্তে; আশীর্বাদ করুন, যাতে উল্টোপাল্টা কিছু না করি। মনে রাখবে যতোই তোমরা রমনীদের দিকে লোভ চিত্তে না তাকাবে, বিয়ে করার চিত্ত উদয় না করবে, ততোই তোমাদের সুখ লাভ হবে। নির্বাণ লাভের পথ সুগম, সহজতর হবে। আবার, তোমাদের চিত্তে যদি জ্ঞান থাকে তাহলে তোমরা কোন রমনীর দিকে লোভ চিত্তে তাকাবে না, তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না। কিন্তু চিত্তে অজ্ঞানতা ভাব থাকলে রমনীর দিকে লোভ চিত্তে তাকাবে এবং বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে। তজ্জন্য দেখতে হবে যে, তোমাদের চিত্তে জ্ঞান আছে কি নেই? তোমাদের চিত্তে জ্ঞান থাকলে বা তোমরা জ্ঞানী হলে কোন রমনীর দিকে লোভ চিত্তে তাকাবে না, বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না। তোমরা জ্ঞানী হয়ে যাও। জ্ঞানী হলে নির্বাণ যেতে পারবে, অজ্ঞান হলে নির্বাণ যেতে পাবে না।
জনৈক ভিক্ষু আমাকে বলেছিল, আমি ইহজন্মে বিয়ে করব না। কারন বর্তমানে সবাই গরীব। গরীব বংশের কন্যা বিয়ে করে সংসারী হলে বিবিধ দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হবে। কাজেই বর্তমান জন্মে আমি বিয়ে করব না। এখন প্রব্রজিত অবস্থায় শীল পালন করে মৃত্যুর পর রাজা হয়ে রাজকন্যা অথবা বিত্ত সম্পত্তির মালিক মহাধনী হয়ে ধনীকন্যা বিয়ে করে সাংসারিক সুখ ভোগ করব। বনভন্তে বলেন, তাহলে সে তো রাজা বা ধনীর ছেলে হলে বর্তমানে ভিক্ষু হতো না। আর নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যেও সে ভিক্ষু হয়নি; ভিক্ষু হয়েছে পরজন্মে রাজা বা ধনী হয়ে জন্ম গ্রহণ করতঃ রাজকন্যা বা ধনীকন্যা বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এ’ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষুসঙ্ঘের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। বনভন্তে এবার সামনে উপবিষ্ট এক ভিক্ষুকে প্রশ্ন করেন- তুমিও কি সেই উদ্দেশ্যে ভিক্ষু হয়েছ? ভিক্ষু বলল-না ভন্তে। বনভন্তে বললেন- আচ্ছা, তোমরা সবাই যদি দায়ক-দায়িকাদেরকে এরূপ বল যে, আমরা ইহজন্মে বিয়ে করব না। পরজন্মে রাজকুলে, ধনীকুলে জন্মগ্রহণ করতঃ রাজকন্যা ধনীকন্যা বিয়ে করব; এবং সেই জন্য আমরা প্রব্রজিত হয়েছি। তাহলে দায়ক-দায়িকাদের মনে কি উদয় হবে বলো তো? ভন্তে, সেটা তো মস্ত-বড়ো লজ্জার কথা হবে। দায়ক-দায়িকারা মনে করবে এরা সবাই গরীব লোকের সন্তান, গৃহীকুলে অন্ন সংস্থানের সুযোগ নেই বলে প্রব্রজিত হয়েছে। দেখ না, কতোই হীন মতলব নিয়ে তারা প্রব্রজিত হয়েছে। ভন্তে, আমরা সে উদ্দেশ্যে প্রব্রজিত হইনি। এবার বনভন্তে ভিক্ষুসঙ্ঘের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা কখনো সেই ভিক্ষুর মত হীন মতলব নিয়ে অবস্থান করবে না। তাহলে তোমাদেরকে দুঃখ পেতে হবে, নির্বাণ লাভ করতে পারবে না। নির্বাণ যেতে হলে ইহকালের আশাও ত্যাগ করতে হয়, পরকালের আশাও ত্যাগ করতে হয়। তোমরা ইহকালের আশা এবং পরকালের আশা ত্যাগ করে অবস্থান কর। এতে নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম হবে।
শ্রদ্ধেয় ভন্তে বলেন- ধর্ম জ্ঞান, ধর্ম চক্ষু লাভ করতে পারলে তবেই সুখ লাভ হয়। আবার সকলের পক্ষে ধর্ম জ্ঞান, ধর্ম চক্ষু লাভ করাও সম্ভব নয়। যারা ত্রিহেতুক পুদ্গল কেবল তারাই ধর্ম জ্ঞান, ধর্ম চক্ষু লাভ করতে সমর্থ হয়। পুদ্গলের মধ্যে অহেতুক, দ্বিহেতুক, ত্রিহেতুকভাবে শ্রেণী বিভাগ রয়েছে। যাদের অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ এই ত্রিহেতু রয়েছে তারাই ত্রিহেতুক। যাদের অলোভ, অদ্বেষ এই দ্বিহেতু রয়েছে তারা দ্বিহেতুক। আর যাদের অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ এ তিনটি হেতুর মধ্যে একটিও নেই তারা অহেতুক। ত্রিহেতুক পুদ্গলেরা দান, শীল, ভাবনা ও ধর্ম দেশনাদি শ্রবণের ফলে ইহজন্মে মার্গফল লাভ করতে পারে। দ্বিহেতুক পুদ্গলেরা ইহজন্মে দান, শীল, ভাবনাদি করার পুণ্যফলে পরজন্মে মার্গফলাদি লাভে সক্ষম হয়। কিন্তু অহেতুক পুদ্গলেরা পাঁচটি সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট ধর্ম দেশনা শ্রবণ সহ পুণ্য কর্মাদি করলে তবেই মার্গফল লাভে সক্ষম হয়। ত্রিহেতুক পুদ্গলেরা নির্বাণ, দ্বিহেতুক ও অহেতুক পুদ্গলেরা দান, শীল, ভাবনাদি করতঃ স্বর্গে যেতে পারে।
নির্বাণ যেতে হলে কেবল মাত্র বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশ গ্রহন করা চাই। নির্বাণ লাভেচ্ছুগণকে বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশ ছাড়া অন্য কারো শিক্ষা, উপদেশ গ্রহণ করা চলবে না। কারন বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশ ভিন্ন অন্য কারো শিক্ষা, উপদেশে নির্বাণ লাভ করা যায় না। অন্য কারো শিক্ষা, উপদেশে নির্বাণ লাভের কথা উল্লে¬খ নেই, নির্বাণ লাভের উপায় বর্ণনা নেই। তাই তোমরা নির্বাণ লাভেচ্ছুগণ বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশ ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা, উপদেশ গ্রহণ করবে না। ভগবান বুদ্ধ ব্যতীরেকে অন্য কাউকে গুরু বলে মেনে নেবে না। মনে রাখবে, একমাত্র ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা, উপদেশ ভিন্ন অন্য কোন গুরুর শিক্ষা, উপদেশে নির্বাণ যেতে পারে না। নির্বাণ যেতে হলে বুদ্ধের শিক্ষা, উপদেশই একমাত্র অবলম্বন। কারোর শিক্ষা গ্রহণ না করে, কারোর উপদেশ না শুনে, শুধুমাত্র বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ এবং বুদ্ধের উপদেশ শ্রবণ করলে নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়। তাই আমার সাথে সাথে বলো “আমরা কারো শিক্ষা গ্রহণ করব না, কারো উপদেশ শুনব না, কেবল বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করব, বুদ্ধের উপদেশ শুনব। এতে আমাদের নির্বাণ লাভ হবে”। বনভন্তে ভিক্ষুসঙ্ঘকে প্রশ্ন করেন- নির্বাণ যেতে হলে কি প্রয়োজন হচ্ছে? কেবল মাত্র বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশ। তাহলে পারবে তো; বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের উপদেশগুলো গ্রহণ করে অবস্থান করতে? হ্যাঁ ভন্তে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তোমরা সর্বদা নির্বাণমুখী চিত্ত হয়ে অবস্থান কর। নির্বাণমুখী চিত্তকে অন্য দিকে ফেরাবে না। অন্যদিকে ফেরালে অর্থাৎ কখনো নির্বাণমুখী, কখনো স্বর্গমুখী, কখনো ব্রহ্মমুখী, কখনো বা মনুষ্য ভূমিমুখী করলে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব হবে না। নির্বাণ লাভ করতে হলে এক বাদে দুই নেই; একমন এক আলম্বন হয়ে থাকতে হয়। সর্বদা চিত্তের মধ্যে একাগ্রভাব বজায় রাখতে হয়। সেই একাগ্রতা কি? একটি বিষয়ে নিশ্চল অবস্থার নাম একাগ্রতা। একটা করতে করতে আরো অন্য একটা করা একাগ্রতার কাজ নয়। আর একাগ্রতা না থাকলে নির্বাণ লাভ করার আশা বৃথা। কাজেই তোমরা সর্বদা নির্বাণমুখী চিত্ত হয়ে অবস্থান কর। মার তোমাদেরকে যতই প্রলোভন দেখাক না কেন, তাতে প্রলুব্ধ হবে না; যতই বাঁধা বিপত্তি অন্তরায় সৃষ্টি করে দিক না কেন, তাতে পিছপা হবে না। এতে পরম সুখ নির্বাণ লাভে সক্ষম হবে।
পরিশেষে তিনি বলেন- তোমরা প্রত্যেকে ধ্যান অনুশীলন কর এবং জ্ঞান উদয় করতে তৎপর থাক; যাতে তোমাদের নির্বাণ সুখ লাভ হয়। আর কোন রমনীর দিকে লোভ চিত্তে তাকাবে না, তাদেরকে বিয়ে করার চিত্ত উদয় করবে না। তাহলে আমি বলছি তোমাদের অবশ্যই নির্বাণ সুখ লাভ হবে। কখনো চিত্তের মধ্যে অজ্ঞানতা ভাব উদয় করবে না। চিত্তের মধ্যে অজ্ঞান থাকলে নির্বাণ লাভ করা যায় না। অজ্ঞানী নির্বাণ লাভ করা দূরে থাক স্বর্গেও যেতে পারে না। অজ্ঞানীরা দেহান্তেই নিরয়ে উৎপন্ন হয়ে থাকে। তাই তোমরা জ্ঞানীই হবে, প-িত হবে; কখনো অজ্ঞানী, মূর্খ হবে না। অজ্ঞানী, মূর্খদের দ্বারা বৌদ্ধধর্মের পরম ও চরম সুখ নির্বাণ লাভ করা সম্ভব নয়। যারা জ্ঞানী, প-িত তারা নির্বাণ লাভে সক্ষম হন। তোমরাও সর্বদা ধ্যানানুশীলন ও জ্ঞান উদয় করতঃ জ্ঞানী, প-িত হয়ে যাও তাহলে পরম সুখ নির্বাণ লাভ করতে সমর্থ হবে এবং তোমাদের যাবতীয় দুঃখের চির অবসান ঘটবে। তোমরা সেই দিকেই (ধ্যানানুশীলন, জ্ঞান লাভ) অগ্রসর হতে থাক।