কোশলরাজ প্রসেনজিতের এক পুরোহিত ব্রাহ্মণ ছিল। তাহার নাম ছিল তোদেয়্য। তিনি মহাধনী ছিলেন। তাহার ধনের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি। কিন্তু তাহার মতো কৃপণ তৎকালীন কেহ ছিল না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পুত্রকন্যাগণ বেশি ব্যয় করিবে মনে করিয়া সর্বদা তাহাদের এইভাবে উপদেশ দিতেন যে-পন্ডিতগণ সামান্য সামান্য অঞ্জন ব্যবহারে বহু অঞ্জনের ক্ষয় করে। উইপোকা তিল তিল মাটি সঞ্চয়ে বৃহৎ বল্মীক নির্মাণ করে। মধুমক্ষিকা বিন্দু বিন্দু মধু সঞ্চয়ে বৃহৎ মধুভাণ্ড পূর্ণ করে। এইভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলনা করিয়া শিক্ষা দিতেন, যাহাতে পুত্রকন্যাগণ দান না দেয় বা সঞ্চিত ধন খরচ না করে।
তখন ভগবান বুদ্ধ নাতিদূরবর্তী বিহারে বাস করিতেন। সেই ব্রাহ্মণ কৃপণতাবশত কোনোদিনও বুদ্ধকে এক চামচ ভাত বা এক মালা যাগু দান দিতে পারে নাই। আজীবন ধনলোভে দিন অতিবাহিত করিয়া মরণান্তে স্বীয়গৃহে এক কুক্কুরীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিল। কুক্কুরী বাচ্ছা প্রসব করিলে বাচ্ছাটি সেই গৃহে পালিত হইতে লাগিল। তোদেয়্যর এক পুত্র ছিল। তাহার নাম শুভ। শুভ কিন্তু তাহা জানে না যে, তাহার পিতা কুকুর হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সে কুকুরের বাচ্চাটিকে বড়ই আদর করিত। তোদেয়্য কুকুর হইয়াও তাহার পূর্বের ধন রক্ষা করিত। তাহার জন্য বাড়িতে কেহ আসিতে পারিত না। আসিলেই ঘেউ ঘেউ করিয়া তাড়াইয়া দিত। ভগবান সর্বজ্ঞ দৃষ্টিতে তাহা দেখিয়া একদিন শুভ-র ঘরে উপস্থিত হইলেন। অমনি কুকুরটি বুদ্ধকে দেখিয়া ঘেউ ঘেউ করিয়া তাড়না দিল।
তখন বুদ্ধ বলিলেন, কী হে তোদেয়্য! তুমি পূর্বে মিথ্যাদৃষ্টির দরুন এখন কুকুর হইয়া জম্মগ্রহণ করিয়াছ। এখন আবার ঘেউ ঘেউ করিয়া আমাকে তাড়না করিতেছ! এই অকুশলের ফলে তুমি নরকে গিয়া জন্মগ্রহণ করিবে।” কুকুরটি এই বাক্য শুনিয়া ভাবিল, ‘অহো! শ্রমণ গৌতম আমাকে জানিতে পারিয়াছেন।’ যাহার কারণে লজ্জায় ও অনুতাপে দুঃখিত হইয়া উনানের পিছনে গিয়া ছারিকাতে (ছাইয়ের উপর) লুটিয়া পড়িল। যে কুকুর সর্বদা ধবধবে বিছানায় শুইত, আজ কেন সে ছারিকায় শুইয়া থাকিল? তাড়াতাড়ি চাকরেরা ধরিয়া বিছানায় শোওয়ানোর জন্য টানিতে লাগিল। কিন্তু কুকুরটি কিছুতেই গেল না। তখন শুভ জিজ্ঞাসা করিল, “এমন হইয়াছে কেন? কে তাহাকে বিছানা হইতে নামাইয়া দিল?” সেবকেরা বলিল, “শ্রমণ গৌতম বলালিয়াছেন পিতাই এই কুকুর, এই কথাটুকু বলায় কুকুরটি বড়ই লজ্জিত হইয়াছে।”
বড় অন্যায়, বুদ্ধ মুখে যাহা আসে তাহাই বলে। আমার পিতা ধনবান ব্রাহ্মণ, সে কি কখনও কুকুর হইতে পারে? আচ্ছা ঠিক আছে, বুদ্ধ যে মিথ্যাবাদী এই কথা আমি প্রমাণ করিব। শুভ বড়ই ক্ষেপিয়া গেল। যাহার জন্য সে তখনই বিহারে গিয়া বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিল, “সত্যই কি ভগবান, আমার পিতা কুকুর হইয়াছে?” “হ্যাঁ!” “তবে প্রমাণ কী? আমাকে বলুন!” “শুন শুভ, তোমার পিতার অকথিত কোনো ধন আছে কি?” “হ্যাঁ আছে।” “আচ্ছা, শুভ তুমি তাহলে বাড়িতে গিয়া কুকুরটিকে শুধু দুগ্ধের পায়স খাইতে দিও, তৎপর যখন একটু তন্দ্রা আসিবে তখন কানে কানে বলিবে- তোমার অকথিত ধন কোথায় আছে আমাকে বলিয়া দাও।” তখন সে তোমাকে ধন দেখাইয়া দিবে। ইহাতে শুভ বড়ই আনন্দিত হইল। আজ হয় ধন পাইব, না হয় বুদ্ধ মিথ্যাবাদী বলিয়া জনসমাজে প্রচার করিয়া দিব। সর্বজ্ঞ বুদ্ধের কথা দুই হওয়ার মতো নয়। শুভ বুদ্ধের উপদেশমতো কাজ করিল, কুকুরটিও সংকেত করিয়া দিল, সেই সংকেতে তাহার ধন লাভ হইল। পরবর্তীকালে আয়ু শেষে মৃত্যুর পর কুকুরটি নরকে জন্ম হইলে শুভ-র মনে বড়ই উদ্বেগ হইল। তাই শুভ বুদ্ধের নিকট গিয়া নিম্নোক্ত ১৪টি প্রশ্ন করিলেন :
১। অল্পায়ু মনুষ্যগণ দেখা যায়, ২। দীর্ঘায়ু মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৩। কঠিন পীড়াগ্রস্ত মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৪। নীরোগ মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৫। বিশ্রী মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৬। সুশ্রী মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৭। বন্ধু-বান্ধবহীন দরিদ্র মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৮। মহাপরিবার-সম্পন্ন ধনী মনুষ্যগণ দেখা যায়, ৯। অল্প ভোগসম্পত্তি-সম্পন্ন মনুষ্যগণ দেখা যায়, ১০। মহাভোগসম্পত্তি-সম্পন্ন মনুষ্যগণ দেখা যায়, ১১। নীচ বংশীয় মনুষ্যগণ দেখা যায়, ১২। উচ্চ বংশীয় মনুষ্যগণ দেখা যায়, ১৩। নির্বোধ মনুষ্যগণ দেখা যায়, ১৪। প্রজ্ঞাবান মনুষ্যগণ দেখা যায়। এইরূপে মানবগণের মধ্যে হীন-শ্রেষ্ঠ দেখা যায় কেন?
ভগবান ইহা শুনিয়া উত্তর প্রদান করিলেনম জগতে জীবগণ স্বকৃত কর্মই ভোগ করে, স্বীয় কর্মের উত্তরাধিকারী হইয়া কর্ম মতেই যোনি গ্রহণ করে। কর্মই নিজের বন্ধু এবং কর্মই নিজেরআশ্রয়স্বরূপ কল্যাণ বা পাপ যে যেই কর্ম করিবে সে সেই কর্মের উত্তরাধিকারী হইবে। কর্মই জীবগণকে হীন ও শ্রেষ্ঠরূপে বিভাগ করে।
শুভ ভগবানের এইরূপ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর বুঝিতে না পারিয়া
বিস্ততৃভাবে বর্ণনা করিবার জন্য পুনঃ ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিলেন। তখন ভগবান বিস্তৃতভাবে বলিতে লাগিলেন :
১। ইহজীবনে স্ত্রী বা পুরুষ যাহারা ঢিল, দণ্ড ও অস্ত্রদ্বারা প্রাণীর প্রতি রুদ্র প্রকৃতি, লোহিত-পাণি, হনন ও প্রহার কার্যে রত হইয়া জীবের প্রতি নির্দয় হয়, প্রাণিহত্যা করে এবং নানা উপায়ে প্রাণীকে মারিয়া ফেলে, তাহারা মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি নিরয়ে উৎপন্ন হয়। যদি তাহারা মনুষ্যজন্ম লাভ করে তবে অল্পায়ু হয়, জন্মে জন্মে অকালে মৃত্যু ঘটে। সত্ত্বগণের অল্পায়ু হইবার কারণ, প্রাণিহত্যার পাপের ফল।
২। যাহারা প্রাণিহত্যা হইতে বিরত হইয়া সর্ব জীবের প্রতি দয়ালু ও হিতানুকম্পী হয়, কোনো প্রাণীকে ঢিল, দণ্ড ও অস্ত্রদ্বারা প্রহার ও হত্যা করে না, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি ¯^M©‡jv‡K উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যজন্ম লাভ করে তবে তাহারা জন্মে জন্মে দীর্ঘায়ু হয়, অকালে মৃত্যু হয় না। দীর্ঘায়ু জীবন লাভের কারণ, প্রাণিহত্যা হইতে বিরত হওয়ার ফল।
৩। ইহজীবনে যাহারা ঢিল, দণ্ড ও অস্ত্র-শস্ত্রদ্বারা প্রাণীকে আঘাত করে, নানা উপায়ে শারীরিক যন্ত্রণা দেয় তাহারা মৃত্যুর পর দুর্গতি অপায় বিনিপাত নিরয়ে উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যজীবন লাভ করে তবে তাহারা বহু রোগগ্রস্ত হয়, নানাবিধ শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে। নানাবিধ রোগগ্রস্ত হইবার কারণ, অতীতে প্রাণীকে শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়ার ফল।
৪। যাহারা প্রাণীকে ঢিল, দণ্ড ও অস্ত্রশস্ত্র বা হস্তদ্বারা প্রহার বা আঘাত করে না, প্রাণীর প্রতি দয়ালু হয়, প্রাণীকে আদরযত্ন করে, ভালোবাসে, মৈত্রীভাব পোষণ করে, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়, তাহারা নীরোগ হয়, অর্থাৎ রোগব্যাধিবিহীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, কিংবা রোগের কারণে তাহারা শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে না। ইহজীবনে নীরোগ হইবার কারণ, অতীতে প্রাণীকে প্রহার বা আঘাত না করিবার ফল।
৫। স্ত্রী বা পুরুষ যাহারা ক্রোধপরায়ণ ও উপায়াসবহুল, সামান্য কথায় রাগান্বিত হয়, কুপিত হয়, ক্ষতি করে, প্রতিহত করে, কোপ-দ্বেষ ও দৌর্মনস্য পোষণ করে, সেইরূপ ব্যক্তিগণ মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি নিরয়ে উৎপন্ন হয়। যদি মানবজীবন লাভ করে, তবে তাহারা বিশ্রী চেহারাযুক্ত হইয়া জন্মগ্রহণ করে। রাগী বা ত্রেুাধী ব্যক্তিগণ জন্মে জন্মে বিশ্রী হয়। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে যাহারা অতি বিশ্রী হয়, তাহারা লোকের দয়া-মায়া, আদর, ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত হয়, লোকের ঘৃণার পাত্র হয়। বিশ্রী চেহারাযুক্ত হইয়া জন্ম হইবার কারণ, অতীতে রাগী বা ক্রোধী হওয়ার পাপের ফল।
৬। যাহারা ক্রোধহীন, অনুপায়াস হয়, বহু কথা বলা হইলেওরাগান্বিত হয় না, কুপিত হয় না, ক্ষতি করে না, প্রতিহত করে না, কোপ-দ্বেষবিহীন হইয়া সকলের প্রতি মৈত্রীপরায়ণ হয় এবং দৌর্মনস্যভাব পোষণ করে না, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করে তবে তাহারা স্ত্রী অথবা পুরুষ যাহাই হউক, সুশ্রী হয় অর্থাৎ সুন্দর দেহধারী হইয়া জন্মগ্রহণ করে। সকলেই তাহাদের ভালোবাসে ও প্রিয়শীল হয়। জন্মে জন্মে মনুষ্যলোকে রূপসম্পত্তি লাভ করিবার কারণ, অতীতে রাগী বা ক্রোধী না হওয়ার ফল।
৭। এই জগতে যাহারা ঈর্ষাপরায়ণ, অন্যের লাভ-সৎকার, সম্মান, পূজা লাভে, প্রশংসায় ও উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়, প্রতিহিংসা করে, ঈর্ষা পোষণ করে, তাহারা মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি নরকে উৎপন্ন হইয়া অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে। যদি মনুষ্যজীবন লাভ করে, তবে তাহারা অল্প পরিবারসম্পন্ন হয়, জ্ঞাতি-মিত্র ও পুত্রকন্যাহীন হইয়া সর্বকাজে দুর্বলতা অনুভব করে। এইরূপে জ্ঞাতি-মিত্র, পুত্রকন্যা লাভ না হইবার কারণ, অতীতে ঈর্ষাপরায়ণ হওয়ার পাপের ফল।
৮। যাহারা অন্যের লাভ-সৎকার, সম্মান, পূজা লাভে, প্রশংসায় ও উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয় না, প্রতিহিংসা করে না, ঈর্ষা পোষণ করে না, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যজীবন লাভ করে, তবে তাহারা বহু পরিবারসম্পন্ন হয়, বহু পুত্রকন্যা ও জ্ঞাতি-মিত্র লাভ করে। যেমন- বুদ্ধ সময়ে পুণ্যবতী বিশাখার দশটি পুত্র ও দশটি কন্যা সন্তান ছিল। এইরূপে বহু পরিবারসম্পন্ন হইবার কারণ, অতীতে প্রতিহিংসা বা ঈর্ষা পোষণ না করিবার ফল।
৯। যাহারা শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের অন্ন-পানীয়-বস্ত্র-যান-মাল্য-গন্ধ-বিলেপন-শয্যা-আবাসন-প্রদীপ প্রভৃতি দানীয় বস্তু থাকা সত্ত্বেও দান করে না, তাহারা মৃত্যুর পর অপায়ে গমন করে। যদিও মনুষ্যজীবন লাভ করে, তবে তাহারা ভোগসম্পত্তি লাভ করিতে পারে না, সম্পত্তিবিহীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং ধনসম্পত্তিবিহীন পরিবারে জন্ম হইবার কারণ, অতীতে বস্তুসম্পদ দান না করিবার ফল।
১০। যাহারা শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের অন্ন-পানীয়-বস্ত্র-যান-মাল্য-গন্ধ-বিলেপন-শয্যা-আবাসন-প্রদীপ প্রভৃতি দানীয় বস্তু দান করে, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্ঘলোকে গমন করে। যদি মনুষ্যজীবন লাভ করে, তবে তাহারা মহাভোগসম্পত্তি লাভী হয়, মহাধনশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং ধনসম্পত্তি লাভ হইবার কারণ, অতীতে বস্তুসম্পদ দান করিবার ফল।
১১। যাহারা অভিমানী হইয়া অভিবাদনযোগ্যকে অভিবাদন করে না, প্রত্যুত্থানযোগ্যকে প্রত্যুত্থান করে না, আসনাদি পাইবার যোগ্যকে আসন দেয় না, মার্গার্হকে মার্গ দেয় না অর্থাৎ রাস্তায় বা পথে সম্মানীয় ব্যক্তিকে দেখিলে রাস্তা ছাড়িয়া দেয় না, মাননীয়কে মান্য করে না, পূজনীয়কে পূজা করে না, মানী ও অহংকারী হয়, তাহারা মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি নিরয়ে উৎপন্ন হয়। যদিও মনুষ্যলোকে জন্ম হয়, তবে অতি নীচকুলে জন্ম হইয়া থাকে। যেমন- চন্দালকুল, নিষাদকুল, বেনুকুল, চর্মকারকুল বা মেথর, ডোম ইত্যাদি নীচকুলে জন্ম হইয়া সকলের পরাধীন হয়। নীচকুলে জন্ম হইবার কারণ, অতীতে অহংকার করিবার পাপের ফল।
১২। যাহারা অভিমানী না হইয়া অভিবাদনযোগ্যকে অভিবাদন করে, প্রত্যুত্থানযোগ্যকে প্রত্যুত্থান করে, আসনাদি পাইবার যোগ্যকে আসন দেয়, মার্গার্হকে মার্গ দেয় অর্থাৎ রাস্তায় বা পথে সম্মানীয় ব্যক্তিকে দেখিলে রাস্তা ছাড়িয়া দেয়, মাননীয়কে মান্য করে, পূজনীয়কে পূজা করে, মান অহংকার করে না, তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্ঘলোকে গমন করে। যদি মনুষ্যলোকে জন্ম হয় তবে তাহারা উচ্চকুলে, উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। উচ্চকুলে জন্ম হওয়ার কারণ, অহংকার না করিবার পুণ্যফল।
১৩। যাহারা দোষযুক্ত মনে বা ঠকানোর জন্য, শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘কুশল কী, অকুশল কী, বর্জনীয় কী, অবর্জনীয় কী, সেবিতব্য কী, অসেবিতব্য কী, কী করিলে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হইবে, কী করিলে দীর্ঘকাল হিত-সুখের কারণ হইবে?’ তাহারা মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি নিরয়ে উৎপন্ন হয়। মনুষ্যকুলে জন্ম হলেও নির্বোধ, মূর্খ, দুষ্প্রাজ্ঞ, প্রজ্ঞাহীন হইয়া থাকে। অজ্ঞান ও মূর্খ হওয়ার কারণ, দোষযুক্ত মনে বা ঠকানোর জন্য অন্যকে প্রশ্ন করিবার পাপের ফল।
১৪। যাহারা প্রসন্নমনে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা লাভ করিবার জন্য শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘কুশল কী, অকুশল কী, বর্জনীয় কী, অবর্জনীয় কী, সেবিতব্য কী, অসেবিতব্য কী, কী করিলে দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের কারণ হইবে, কী করিলে দীর্ঘকাল হিত-সুখের কারণ হইবে?’ তাহারা মৃত্যুর পর সুগতি ¯^M©‡jv‡K উৎপন্ন হয়। যদি মনুষ্যজীবন লাভ করে, তবে তাঁহারা জ্ঞানবান, প্রজ্ঞাবান ও সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হন। জন্মে জন্মে প্রজ্ঞাবান হইবার কারণ, প্রসন্নমনে কুশলাকুশল বিষয়ে জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করিবার পুণ্যফল।
এইরূপে মানুষ হইতে দেবতা, যক্ষ, নাগ, প্রেত, অসুর, পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ, দৃশ্য-অদৃশ্য, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, জগতের সমস্ত প্রাণীই নিজ নিজ কর্ম দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। ¯^xq কুশল-অকুশল কর্ম হইতেই সত্ত্বগণের সুখ-দুঃখের উৎপত্তি হয়। কিন্তু তাহা সকল স্তরের সত্ত্বগণ অবগত নহে। ইহা যাহারা জ্ঞাত হইয়াছেন, উপলব্ধি করিয়াছেন, একমাত্র তাহারাই অকুশল পরিত্যাগ করিয়া দান, শীল, ভাবনা, মাতাপিতার সেবা ইত্যাদি কুশল ও মঙ্গলজনক কর্ম সম্পাদন করিয়া থাকেন। এই সমস্ত পুণ্যকর্ম সম্পাদন করা মানবজীবনেই একমাত্র সম্ভব হয়। পুণ্যকর্ম সঞ্চয় ও পারমী পূরণ করিবার জন্য মানবজীবনই শ্রেষ্ঠ ও সুবর্ণ সুযোগ। মনুষ্য ব্যতীত অন্যান্য লোকভূমিতে তেমন সুযোগ হয় না।
সত্ত্বগণের দুঃখ বা ভয় সম্পর্কে উপমার সাহায্যে বলা যায়, অস্ত্রদ্বারা মানুষ হত্যা করা যায়, তাই মানুষ অস্ত্রকে ভয় করে। অগ্নি প্রাণীসমূহকে দগ্ধ করে, তাই লোকে অগ্নিকে ভয় পায়। বিষপানে মানুষের মৃত্যু হয়, তাই বিষ আমাদের ভয়ের কারণ। তেমনই পাপ, অকুশল কর্ম আমাদের যেভাবে দুঃখ প্রদান করে, তাহা যদি মানুষেরা প্রকৃতরূপে জানিতে পারিত, তবে নিশ্চয়ই পাপকে ভয় ও ঘৃণা করিত এবং বিন্দুমাত্রও পাপকাজ করিত না। তাই মানুষের পাপ-পুণ্যের ফলাফল m¤^‡Ü জানা আর কর্মফল বিশ্বাস করা অবশ্যই প্রয়োজন। বুদ্ধ বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি সত্যধর্মকে না জানিয়া শতবর্ষ জীবিত থাকে, তাহার জীবন হইবে বৃথা, কিন্তু যিনি সত্যধর্ম জানিয়া মাত্র একদিনও বাঁচিয়া থাকেন, তাহার জীবন সার্থক হয়।” মানবজীবন অতি দুর্লভ, এই দুর্লভ জীবন সার্থক করিতে হইলে আমাদের অবশ্যই ধর্মাচরণ করিতে হইবে। ধর্মাচারী লোক ইহলোকে ও পরলোকে সুখে থাকেন। ধর্মই মানুষকে উত্তম হইতে উত্তম, শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠের দিকে নিয়া যায় এবং ¯^M©, ব্রহ্মাদিসহ নির্বাণপ্রাপ্ত করায়। ধর্মহীন মানুষ পশুসদৃশ। আর সকল কুশল ধর্মের মূলই হইতেছে শীল।
বুদ্ধ সর্বজ্ঞতা জ্ঞানে শীলের মাহাত্ম্য বর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন, “শীলের দ্বারা মানুষের যে কল্যাণ সাধিত হয়, অন্য কোনো কিছুই সেইরূপে কল্যাণ করিতে পারে না। জগতে শীলের ন্যায় মহৎ গুণ অন্য কোথাও নাই এবং শীলের ন্যায় মূল্যবান আর দ্বিতীয় সম্পত্তি নাই। শীলের গুণ অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়।” তজ্জন্য বলা হইয়াছে-
শীলেই কল্যাণ হয়, শীলের সমান,
এই জগতে অন্যগুণ নাহি বিদ্যমান।
দেবলোকে ও মনুষ্যলোকে যত রাজা-মহারাজা, জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী শ্রাবক বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ ও অসংখ্য সম্যক সম্বুদ্ধ অতীত হইয়াছেন, তাঁহারা সকলে শীলকে আশ্রয় করিয়া শীলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া সর্বদুঃখ হইতে মুক্ত হইয়াছেন। অনাগতে যাঁহারা রাজা-মহারাজাদি, জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী শ্রাবক বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ ও সম্যক সসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হইবেন তাঁহারাও সকলে শীলকে আশ্রয় করিয়া, শীলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া সর্বদুঃখ হইতে মুক্ত হইবেন। কারণ শীল ব্যতীত শ্রেষ্ঠ মানব হওয়া যায় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বর্তমানে অবিদ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানবেরা শীলের এই মহৎ গুণ না বুঝিয়া শীল পালনে বিমুখ হইয়াছে, শীল পালনে অবহেলা করিতেছে। দুগ্ধপোষ্য শিশু যেমন মলকে ঘৃণা করে না, অন্যদিকে মূল্যবান স্বর্ণ-মুনি-মুক্তা-রত্নাদি
হস্তগত হইলেও তাহা যত্ন করে না। কারণ তাহাদের কাছে মল এবং মণি-রত্নাদি একই সমান। তেমনই অজ্ঞানীরা এই দুর্লভ মানবজন্ম লাভ করিয়াও শীলের গুণ জানে না, শীল পালনে অবহেলা করে। অন্যদিকে পাপকেও ঘৃণা করে না, পাপ করিতে লজ্জা ও ভয় করে না। তাহাদের কাছে শীলের কোনো মূল্য নাই। তাই অজ্ঞানীদের শিশুসদৃশ বলা যায়। শিশু জ্বলন্ত অগ্নি সামনে পাইলে অগ্নি স্পর্শ করিতেও দ্বিধাবোধ করে না। অথচ অগ্নি স্পর্শে কীরূপ দুঃখ যে ভোগ করিতে হইবে তাহা সে জানে না। তেমনই অজ্ঞানী ব্যক্তিও পাপের ফল যে কীরূপ দারুণ দুঃখ প্রদান করে, তাহা না জানিয়া নির্ভয়ে নিঃসংকোচে পাপ করিয়া থাকে, পরে অনুতপ্ত হয় এবং অশেষ দুঃখভোগ করে।
সব্বে সত্ত্বা সুখিতা ভবন্তু